জলাতঙ্ক রোগ, নাম শুনলেই আমরা অনেকে ভয় পাই। ভয় পেলেও জলাতঙ্ক সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ধারনা কম। তাই আজ আমরা জলাতঙ্ক কি, জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ এবং জলাতঙ্ক রোগের প্রতিকার, জলাতঙ্ক রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করবো/।
জলাতঙ্ক কি
জলাতঙ্ক একটি রোগের নাম, মেডিক্যাল পরিভাষায় একে হাইড্রোফোবিয়া (HYDROPHOBIA) বলা হয়।
জলাতঙ্ক রোগ কি
জলাতঙ্ক একটি ভাইরাস জাতীয় জুনোটিক টাইপ রোগ। জুনোটিক টাইপ রোগ বলতে বুঝায় যে টাইপের রোগ গুলো প্রথমে প্রাণীদেহে হয় এবং পরে মানবদেহে ছড়িয়ে থাকে।
জলাতঙ্ক রোগটিও প্রথম প্রাণীদেহে হয়। এরপর ঐ প্রাণী যদি কোন মানুষকে কামড়ায় কিংবা আচোড় দেয়, অথবা প্রাণীটির লালার সংস্পর্শে কোন মানুষ আসলে সেই ক্ষেত্রে সেই মানুষটির জলাতঙ্ক হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়। কোন মানুষ যদি একবার জলাতঙ্ক কর্তৃক আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে তার দ্বারা আরো মানুষের মধ্যে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে।
জলাতঙ্ক কাকে বলে
যে রোগে মানুষ জলকে ভয় পায় অর্থাৎ রোগীর প্রচুর জল পিপাসা লাগলেও সে পানি খেতে ভয় পায়, সেই রোগকে জলাতঙ্ক বলা হয়।
জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসের নাম কি
জলাতঙ্ক রোগের কারন র্যাবিক্স নামের ভাইরাস। র্যাবিক্স বা জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসের নাম রেবিস লিসাভাইরাস (RABIES LYSSAVIRUS)। মেডিক্যালি জলাতঙ্ক রোগকে হাইড্রোফোবিয়া (HYDROPHOBIA) নামে ডাকা হয়।
জলাতঙ্ক রোগের কারণ
সাধারনত রেবিস লিসাভাইরাস (RABIES LYSSAVIRUS) নামক ভাইরাসের কারনেই জলাতঙ্ক রোগ হয়ে থাকে। এই ভাইরাস-ই জলাতঙ্ক রোগের একমাত্র কারণ।
জলাতঙ্ক রোগ হলে কি হয়
জলাতঙ্ক রোগ হলে আক্রান্ত রোগী মৃত্যু অবধারিত। অর্থাৎ জলাতঙ্ক রোগ হলে রোগী বাঁচেনা। রোগটি হওয়ার পর রোগী পানি বা জল দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, এসময় রোগী অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েন। রোগী পানি ছাড়াও অন্যান্য খাবার খেতে কষ্ট পান। এছাড়া রোগী খিঁচুনি, ঝিমুনি, নিস্তেজ, অসারতা সহ শ্বাসকষ্টের মত নানা জটিল সমস্যায় ভোগেন।
কোন কোন প্রাণী কামড়ালে জলাতঙ্ক হয়
গৃহপালিত প্রাণীর মধ্যে কুকুর, বিড়াল, গরু এমনকি মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি থেকে জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে ।
বন্য প্রাণীর মধ্যে শেয়াল,বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি, নেকড়ে, শূকর, গাধা, ঘোড়া, উট, বানর, ইঁদুর, বাদুড়, বেজি, চিকা,খরগোশ ইত্যাদি থেকেও জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে।
জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ
জলাতঙ্ক ভাইরাস বহনকারী কোন প্রাণী কর্তৃক কোন ব্যাক্তি সংক্রমিত হলে, সংক্রমিত ব্যাক্তির মধ্যে জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৩০ দিন থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কামড়ের উপর অর্থাৎ সংক্রমিত স্থানের অবস্থার উপর ভিত্তি করে এই সময় ১০০-১২০দিন পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে।
মানুষের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ হিসেবে নিম্নোক্ত লক্ষন গুলি প্রকাশ পাবেঃ
১. প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে ফ্লু (FLU) রোগের লক্ষন দেখা যায়।
২. রোগীর মধ্যে দুর্বলতা বা অস্বস্তি, জ্বর এবং মাথাব্যথা ইত্যাদি দেখা দেয়।
৩. বমি, দুশ্চিন্তা, বিভ্রান্তি, কোন কিছু গিলতে অসুবিধা, অত্যধিক লালা, হ্যালুসিনেশন(HALLUCINATIONS), অনিদ্রা ইত্যাদি দেখা দেয়।
জলাতঙ্কের লক্ষণ – প্রাণীদের ক্ষেত্রে
জলাতঙ্ক থেকে সতর্ক থাকতে গিয়ে সকল প্রাণীদের জলাতঙ্কের বাহক ভাবলে চলবেনা। কারন জলাতঙ্ক আক্রান্ত প্রানির সংখ্যা কম, তাই জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীদের থেকে সাবধানে থাকা কঠিন না।
চলুন জেনে নেই জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর লক্ষনঃ
কোন প্রাণী জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলে জলাতঙ্কের লক্ষণ হিসেবে তার মধ্যে অস্বাভাবিক আচারণ দেখা দেয়। যেমনঃ পাগলাটে আচরণ, আলোকে ভয় পাওয়া, স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত এবং খিঁচুনি, আক্রমনাত্মক আচরণ এমনকি অপ্রত্যাশিতভাবে স্নেহপূর্ণ আচরণ দেখা যেতে পারে। দিনে দেখা যায় এমন প্রাণীকে রাত্রে কিংবা রাত্রে দেখা যায় এমন প্রাণীকে দিনে বিচরণ করা দেখা যেতে পারে। প্রাণীটির মধ্যে আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা দেখা দিতে পারে, অর্থাৎ আলো সহ্য করতে পারছেনা কিংবা অন্ধকার-এ থাকছেনা এরকম হতে পারে।
কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ
জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর মধ্যে কুকুরের পরিমান উল্লেখযোগ্য। তাই কুকুরদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের রোগের ব্যাপারে সচেনতনতার ও বিশেষ দরকার। চলুন জেনে নেই কুকুরের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ সমুহঃ
জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত কুকুরের মেজাজ বিগ্রে যায়, অর্থাৎ শান্ত মেজাজের কুকুর হটাত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। আক্রান্ত কুকুর লুকিয়ে থাকার চেষ্টা সহ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া দিন বাড়ার সাথে সাথে জ্বর, বমি এবং শরীরের কর্মহীনতা (প্যারালাইসিস), দুর্বলতা, পক্ষাঘাত, খিঁচুনি, শ্বাস নিতে অসুবিধা, গিলতে অসুবিধা, অত্যধিক লালা, অস্বাভাবিক আচরণ, আগ্রাসন এবং নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখা দিতে পারে।
জেনে নিতে পারেনঃ
কুকুর কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়
বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ
বিড়ালের জলাতঙ্ক হওয়ার সম্ভবনা খুবি কম। এবং গৃহপালিত বিড়ালের ক্ষেত্রে বিড়ালের জলাতঙ্ক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে।
তারপরও যদি কোনো বিড়াল জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে নিম্নোক্ত লক্ষনগুলি দেখা যায়ঃ
- জ্বর হওয়া।
- অস্বাভাবিক আচরণ।
- আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।
- প্রচুর লালা পরা।
- প্যারালাইসিস কিংবা কোমায় চলে যাওয়া।
গরুর জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ
গরুর জলাতঙ্ক রোগের তেমন কোন উদাহরণ নেই। গৃহপালিত প্রানী হওয়ার গরুর জলাতঙ্ক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তারপরও গরুর জলাতঙ্ক হলে অন্যান্য প্রানীর মত একই লক্ষন প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ গরুর জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ এবং অন্যান্য প্রানীর জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ একই।
জলাতঙ্ক রোগের পরীক্ষা
ফ্লুরোসেন্ট অ্যান্টিবডি (FA) পরীক্ষা (FLUORESCENT ANTIBODY (FA) TEST) করার মাধ্যমে জলাতঙ্ক রোগের পরীক্ষা করা হয়।
জলাতঙ্ক রোগ কি ছোঁয়াচে
না জলাতঙ্ক রোগ কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটা আক্রান্ত প্রাণী বা মানুষের সংস্পর্শে আসলেই বা ছুলেই সংক্রমণ ছড়ায় না, এর জন্য আক্রান্ত ব্যাক্তি/প্রাণীর কামড়/লালা অপর ব্যাক্তি/প্রাণীর খোলা ক্ষতের সংস্পর্শে আসতে হবে।
জলাতঙ্ক রোগের টিকার নাম কি
জলাতঙ্ক রোগের টিকার নাম হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিন (HUMAN DIPLOID CELL VACCINES – HDCV) । জলাতঙ্ক রোগের এই টিকা ১০০ ভাগ কার্যকারী এবং নিরাপদ।
জলাতঙ্ক রোগের টিকা কে আবিস্কার করেন
জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিস্কার করেন লুই পাস্তুর (LOUIS PASTEU) । ১৮৮৫ সালে এই টিকা প্রথম ব্যবহার করা হয় ।
জলাতঙ্ক টিকার মেয়াদ কতদিন
জলাতঙ্ক রোগের টিকার মেয়াদ কোন টিকা নেওয়া হচ্ছে, এবং কোন অবস্থায় নেওয়া হচ্ছে এসবের উপর নির্ভর করে। সাধারনত জলাতঙ্ক রোগের টিকার মেয়াদ ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। সঠিক মেয়াদ জানতে টিকা প্রদানকারী ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
জলাতঙ্ক রোগের টিকার দাম
বিভিন্ন ব্যান্ডের / কোম্পানি ভেদে টিকার দাম ভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে কিছু ব্যান্ডের টিকার দাম দেওয়া হলঃ
টিকার নাম | টিকার ব্যান্ড/কোম্পানি নাম | টিকার দাম |
রাবিপুর (RABIPUR) | নোভার্টিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড (Novartis (Bangladesh) Ltd.) | ৬৪০ টাকা |
রাবিভ্যাক্স (RABIVAX) | পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (Popular Pharmaceuticals Ltd.) | ৫০০ টাকা |
রাবিক্স-ভিসি (RABIX-VC) | ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড (Incepta Pharmaceuticals Ltd.) | ৫০০ টাকা |
ভেরোরাব (VERORAB) | এসিআই লিমিটেড (ACI Limited) | ৬৪৮ টাকা |
জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেওয়ার নিয়ম
টিকা দেওয়ার জন্য আপনার নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। সেখানকার ডাক্তারকে আপনার ক্ষত এর ব্যাপারে ডিটেইলস বললে, সে আপনাকে আপনার জন্য টিকা দেওয়ার নিয়ম বলে দেবেন। আগে কোন টিকা নেওয়া থাকলে, কতদিন আগে নিয়েছিলেন, কয় ডোজ নিয়েছিলেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত ডাক্তারকে বলুন।
জলাতঙ্ক রোগের টিকা কোথায় পাওয়া যায়
জলাতঙ্ক রোগের টিকা বিনামূল্যে নিতে চাইলে সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। সাধারনত সরকারি হাসপাতাল থেকে এই টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এছাড়া টাকা দিয়ে কিনে নিতে চাইলে যেকোনো ফার্মেসী তে জলাতঙ্ক রোগের টিকা পাওয়া যাবে।
বিড়াল কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়
বিড়াল পোষা প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়া বাড়ির আশে পাশে এদের বিচরণ চোখে পরার মত। তাই এদের সাথে দুষ্টমি করতে গেলে, কিংবা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এদের আঘাত করলে, প্রতিরক্ষা হিসেবে এরা কামড় বা নখের আচর দিতে পারে। এরকম পরিস্থিতে মনে হয় ভ্যাকসিন দিতে হবে কিনা, কিংবা বিড়াল কামড়ালে কত দিনের মধ্যে টিকা দিতে হয়, এই প্রশ্ন গুলো অনেকেরই থাকে। তবে বিড়াল কামড়ালেই, বা খামচি দিলেই যে টিকা দিতে হয় বিষয়টা এমন না। পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রে বিড়ালের কামড়ে টিকা না দিলেও চলে, যদি না এটার র্যাবিস হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে। তবে বিড়ালের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক মনে হলে, দ্রুত প্রথম ডোজ টিকা নিয়ে নিতে হবে। বাকি ডোজ গুলো ডাক্তাতের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।
জলাতঙ্ক রোগের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
জলাতঙ্ক রোগের টিকা নেওয়ার পর টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমনঃ টিকা/ইনজেকশন নেওয়ার জায়গায় ব্যথা, লালভাব, ফোলাভাব বা চুলকানি, এবং মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, পেশী ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনার যেকোনো সমস্যায় এই ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।